একজন ক্রিকেট ঋষি অ্যালিস্টার কুক
ক্রিকেট এখন আর সেই লাল বলের খেলা নেই। কেরি প্যাকারের উত্থান, ওয়ানডে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা, ২০০৪ এ প্রথম টি-টুয়েন্টি, প্রথম আইপিএল এর প্রথম ম্যাচেই ম্যাককালামের সেঞ্চুরি, আইপিএল ঘিরে উন্মাদনা, দেশে দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ- ক্রিকেটটা যেন দিন-দিন চার-ছক্কার খেলা হয়ে যাচ্ছে। ছয় দেখার জন্য স্টেডিয়াম যাই, আউট দেখার জন্য কে যায়?
কিন্তু এই মার-কাটারির যুগে এমন একজন ছিলেন যাকে আসলেই লাল বলের ঋষি বলা যায়। যার মধ্যে কোনো তাড়াহুড়া নেই, কোনো এক্সট্রা শট নেই, বাজে বল আসলে প্রহার, ভালো বলে লিভ করা কিংবা ডিফেন্ড করা- তাঁর শুধু একটাই লক্ষ্য উইকেটে পড়ে থাকতে হবে।
ক্রিকেটের বেসিক ব্যাটিং নিয়মও তাই বলে। আপনি যত উইকেটে পড়ে থাকবেন, তত বেশি রান পাবেন।
এই মন্ত্র অনুসরণ করেই ১৬১ ম্যাচে ৪৫.৩৫ গড়ে ১২৪৭২ রান করেছেন। টেস্ট ক্রিকেটের পাঁচ জন সর্বোচ্চ রান-সংগ্রাহকের মধ্যে একজন। ৩৩টি সেঞ্চুরি টেস্ট ক্রিকেটে তাও একজন ওপেনার হয়ে।
সত্যিই টুপি খুলে সম্মান করার মতো স্ট্যাট। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, কার কথা বলছি? বলছিলাম এ বছর অবসর নেওয়া ইংলিশ ক্রিকেটার অ্যালিস্টার কুকের কথা।
অ্যালিস্টার কুকের জন্ম এবং বেড়ে উঠা
১৯৮৪ সালের ক্রিসমাসে ইংল্যান্ডের গ্লচেস্টারে জন্মগ্রহণ করেন অ্যালিস্টার কুক। বাবা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার এবং মা ছিলেন শিক্ষক। অন্যসব ক্রিকেটার থেকে কুকের শুরুটা ছিলো অন্যরকম।
সংগীতে দক্ষতা ছিল তাঁর। আট বছর বয়সে সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল স্কুলে ক্ল্যারিওনেট বাজানো শিখতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। এই অনুশীলন যে ক্রিকেটেও তাঁর মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করেছিল তা স্বীকার করেছিলেন তিনি।
উইকেটে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যাটিং করতে যে মনোযোগের প্রয়োজন হয় তা তিনি তাঁর ক্ল্যারিওনেট প্র্যাক্টিস থেকে শিখেছিলেন।
১৩ বছর বয়সে শিফট হোন বেডফোরড স্কুলে। বেডফোরডে পড়া অবস্থায় তিনি স্যাক্সোফোন এবং পিয়ানো বাজানো শিখেন।
তবে তাঁর এই সংগীত ক্যারিয়ার খুব তাড়াতাড়ি নিভে যায় যখন এমসিসি খেলতে আসে তাঁর স্কুলে। এমসিসির একটা
খেলোয়াড় অনুপস্থিত থাকায় কুককে দলে টানে এমসিসি। সেই ম্যাচে কুক সেঞ্চুরি করেছিলেন।
তাঁর স্কুলের বাকি চার বছরে তিনি ১৭টা সেঞ্চুরি করেন এবং রান করেন ৪৩৯৬। গড় ছিল চোখ কপালে তোলার মতো, ৮৭.৯০।
সেই সাথে তিনি তাঁর স্কুলের “মিউজিক সোসাইটি”-র প্রেসিডেন্ট ছিলেন। নিজের শেষ বছরে স্কুল ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গড় নিয়ে মৌসুম শেষ করেন। সেবার তাঁর গড় ছিল ১৬০.৮৭।
প্রথম শ্রেনির ক্রিকেটে কুক
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে শুরুটা স্বপ্নের মতো ছিল। যেখানেই খেলেছেন রান করেছেন। এসেক্স এর হয়ে এখন পর্যন্ত ৩০টি সেঞ্চুরি এবং ৫০টি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন। এভারেজ ৪৭.৩৮ যা শুরুর মৌসুমে ছিল ১৪১।
ইংল্যান্ড দলে সুযোগ পান ২০০৬ সালে। শুরুটা স্বপ্নের মতো। মার্কাস ট্রেসকোথিকের অনুপস্থিতিতে ২১ বছর বয়সেই ভারতের বিপক্ষে অভিষেক হয় অ্যালিস্টার কুকের।
প্রথম ইনিংসে ১৬০ বল খেলে করেছিলেন ৬০ রান এবং পরবর্তী ইনিংসে করেন ১০৪ রান। সেবার পাকিস্তান ইংল্যান্ডে খেলতে আসলে তাদের বিরুদ্ধে সিরিজে ৪০৩ রান করেন। নিজের অভিষেক বছরেই কুক এক পঞ্জিকাবর্ষে হাজার রান করেন।
তবে অ্যালিস্টারকে মনে রাখতে আমার কাছে দুইটা স্মৃতি যথেষ্ট। ২০১০-১১ অ্যাশেজে ৭৬৬ রান, ৩টা সেঞ্চুরি এবং গড় ১২৭.৬৬। সেবার কুককে আউট করার কোনো ফর্মুলা জানা ছিল না অজি বোলারদের কাছে।
ব্রিসবেনের গ্যাবায় দ্বিতীয় ইনিংসে ২৩৫ রান করেন তিনি। আরেকবার মনে রাখব ২০১৫ সালে আবুধাবিতে পাকিস্তানকে খাটিয়ে মারা।
দুইদিন ব্যাট করেন সেবার তিনি। ২৬৩ রান করে পাকিস্তানকে একাই ম্যাচ থেকে ছিটকে দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের নৈতিক অবক্ষয়, এক অশনি সংকেত- পড়তে ক্লিক করুন
শচীন টেন্ডুলকারের রেকর্ড ভাঙ্গার পথে অ্যালিস্টার কুক
মাঝে তাঁর অসাধারণ ফর্মের জন্য আশা করা হচ্ছিল তিনি শচীনের রেকর্ড হয়ত ভেঙ্গে ফেলবেন। তবে গত দুই বছর কয়েকটি ইনিংস ছাড়া সিঙ্গেল ডিজিটেই আউট হচ্ছিলেন বারবার।
এভারেজটাও ৫২ থেকে নেমে এসেছিল ৪৫-এ। তাই এ বছর ভারতের সঙ্গে হোম সিরিজেই বিদায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
অ্যালিস্টার কুক ক্যাপ্টেন হিসাবেও ছিলেন সফল। দুইটি অ্যাশেজ, ভারতে সিরিজ জেতা এবং উপমহাদেশে ইংল্যান্ডের ভালো পারফরম্যান্স তাঁর ক্যাপ্টেন্সির সময়ে হয়েছে।
ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রান করা বাঁহাতি ব্যাটসম্যান তিনি, ১২৪৭২ রান। ওপেনারদের মধ্যে সর্বোচ্চ। সবচেয়ে কম বয়সে ৬০০০, ৭০০০, ৮০০০, ৯০০০, ১০০০০, ১১০০০ এবং ১২০০০ রান করেছেন।
যে ৩০ বছরে ভিরাট কোহলি সাত হাজার রান ছুঁইছুঁই সেই জায়গায় কুক মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই ১২০০০ রান করেছেন।
কুক কেনো ব্যতিক্রম
কুক কেনো ব্যতিক্রম? কুকের হাতে সাঙ্গাকারার মতো নিখুত কাভার ড্রাইভ ছিল না, শচীনের মতো স্ট্রেট ড্রাইভ, ব্রায়ান লারার মতো শক্তিশালী পাঞ্চ ছিল না, দ্রাবিড়ের ফ্লিকের মতো ফ্লিক ছিল না।
তবে কুকের যে ব্যাপারটা তাঁকে অন্য দশটা ব্যাটসম্যান থেকে আলাদা করেছে তা হলো ধৈর্য,উইকেটে পড়ে থাকার আকাঙ্ক্ষা। খুব বেশি ভুল শট খেলতেন না, খুব বেশি বলছি কেনো!
যে খেলোয়াড় তাঁর পুরো ক্যারিয়ারে ৮৫% শট সঠিক খেলেছে তাঁকে ভুল শট খেলার অপবাদ দেওয়া যায় না। তাঁর বল বোঝার ক্ষমতা তাঁকে আর দশটা ব্যাটসম্যান থেকে আলাদা করেছে।
ঠান্ডা মাথায়, কোনো তাড়াহুড়ো নেই, আস্তে আস্তে সেট হয়ে রান করা, উইকেট থ্রো না করা- এই ব্যাপারগুলো আধুনিক ক্রিকেটে খুব বেশি ব্যাটসম্যানের মধ্যে নেই।
কুক স্টাইলিশ প্লেয়ার না, তাঁর খেলা দেখলে আপনার ঘুম আসবে, বিরক্ত হয়ে বলতে পারেন, “কি প্লেয়ার, খালি ঠেকায়!”
কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, এই ব্যাটসম্যান যেদিন সেট হবে সেদিন ম্যাচ আমাদের। তাঁর সেঞ্চুরিগুলোকে বলা হয় ড্যাডি সেঞ্চুরি। ক্যারিয়ারে যতবার ১০০ পার করেছেন, বেশির ভাগ সেঞ্চুরি ১৫০ পার করে থেমেছে।
পড়তে ক্লিক করুনঃ ক্রিকেট বিশ্বে অন্যতম পরাশক্তি হয়ে উঠছে বাংলাদেশে
আমাদের বাংলাদেশ কিংবা ভারত অথবা ক্রিকেট বিশ্বের যেকোনো দলের ওপেনারদের ইংলিশ কন্ডিশনে রেকর্ড বাজে। খুব বেশি টেকনিক্যালি স্ট্রং না হলে সেখানে টেকা মুশকিল।
অথচ অ্যালিস্টার একজন ওপেনার হয়েও তাঁর রেকর্ড এতটা সমৃদ্ধ। যে কন্ডিশনে পেস বল স্পিন বলের মতো আচরণ করে, ১৩০-১৪০ কিমি গতিতে বল স্পিনের মতো বাক খায়, সেখানে এতো রান।
অবশ্য হোম কন্ডিশন বলে অনেকে বলতে পারেন, তা আর এমন কি! তবে ইংলিশ ক্রিকেটার হয়ে অস্ট্রেলিয়ার গ্যাবায় যাকে পেস স্বর্গ বলা হয় সেখানে ২৩৫ রান, ভারতের স্পিনিং কন্ডিশনে ১৬০ রান কিংবা আবুধাবির তপ্ত মরুভূমির গরমে ২৬৩ রান। এরকম ওপেনার আর কি আসবে কখনো বিশ্ব ক্রিকেটে?
ঋষি হয়ে উঠা
নিজের শেষ টেস্টটাও নিজের রঙে রাঙিয়েছেন কুক। নিজের শেষ টেস্টে খেলেন ১৪৭ রানের এক ইনিংস যা দিয়ে টেস্ট ইতিহাসের পঞ্চম খেলোয়াড় যিনি প্রথম এবং শেষ টেস্টে সেঞ্চুরি করার ক্লাবে নাম লিখিয়েছেন।
ইংলিশ ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান, ইংলিশ ক্রিকেটের সফল ক্রিকেটারদের মধ্যে একজন হওয়ার সুবাদে নতুন বছরে নাইটহুড উপাধি পাচ্ছেন তিনি। ২০১৯-এ যখন কাউন্টি খেলতে মাঠে নামবেন তখন তাঁর নামের পাশে থাকবে “স্যার” উপাধি।
শুভ আগাম জন্মদিন “স্যার অ্যালিস্টার কুক” যিনি আমার কাছে চিরদিন মনে থাকবেন টেস্ট ক্রিকেটের ঋষি হিসেবে।