এক যে ছিল রাজা: মহারাজার ভিন্নভাবে প্রত্যাবর্তন | সিনেমা রিভিউ

এক যে ছিল রাজা সিনেমা রিভিউ

এক যে ছিল রাজা সিনেমা রিভিউ

চলচ্চিত্র পর্যালোচনা : এক যে ছিল রাজা

মহারাজার ভিন্নভাবে প্রত্যাবর্তন

ছবি মুক্তিঃ ১২ অক্টোবর, ২০১৮


ভাওয়াল রাজার আলোচিত ‘Srimati Bibhabati Devi v/s Kumar Ramendra Narayan Roy and others (1936– 42)’ নামের মামলা নিয়ে সিনেমায় এর আগেও কাজ হয়েছে। বাংলাদেশেই ১৯৬৬ সালে খ্যাতিমান পরিচালক খান আতাউর রহমান নির্মান করেন ‘রাজা সন্ন্যাসী’। একই বছর রওনক চৌধুরীর ছবি ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী’ মুক্তি পায়। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় পীযুষ বসু পরিচালিত ছবি ‘সন্ন্যাসী রাজা’, যাতে রাজার চরিত্রে ছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমার। ছবিটি সেসময় দারুন সাড়া ফেলে এর সিনেমাটিক উপস্থাপনার জন্য। এমনকি সাম্প্রতিককালে কলকাতার স্টার জলসায় দেখানো হয় ‘সন্ন্যাসী রাজা’ নামের একটি সিরিয়াল। তবে এসব কিছুকে ভিন্নভাবে ছাড়িয়ে গেছে সৃজিত মুখার্জীর ‘এক যে ছিল রাজা‘।

পার্থ চ্যাটার্জীর PRINCELY IMPOSTOR? The Kumar of Bhawal and the Secret History of Indian Nationalism যারা পড়েছেন তারা খুব সহজেই ছবিটি দেখে হয়ে যেতে পারেন একচ্ছত্র। কারন পরিচালকের ভাষ্যমতে তার নির্মান প্রায় হুবহু এই বইটির অনুকরনেই বানানো। প্রায় বললাম একারনে, সিনেমা বানাতে গিয়ে পরিচালক তার নিজস্ব ভঙ্গিমা আর মোচড় রাখতে কিছু সংযোজন বা পরিমার্জন করে থাকেন। যেমন এই ছবিতে কেসে বাদী পক্ষের উকিল হিসেবে অনুপমা আর রাজার কলকাতা গমনের সময় ব্রিটিশ বিদ্রোহের আগুন দেখানোটা ছিল সেরকম।

শুটিং হয়েছে মুর্শিদাবাদ, দার্জিলিং, বেনারস, রাজস্থান।

এক যে ছিল রাজা
এক যে ছিল রাজা যীশু

এক যে ছিল রাজা সিনেমার গল্প সংক্ষেপ

সিনেমায় গল্পের শুরুটা হয় আদালতে কেসের দুই উকিলের জেরা দিয়ে। অনুপমার ভাষ্যমতে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সেই লোক একজন প্রতারক মাল সিং আর বাদীর উকিল ভাস্করের দাবি ইনিই সেই রাজা মহেন্দ্র চৌধুরী। রাজার ব্যাকড্রপ হিসেবে দেখানো হয় তার দুটি রুপ। একদিকে তিনি প্রজাবাৎসল, সুশাসক আবার অন্যদিকে বেশ্যা, মদ আর আড্ডায় বুদ হয়ে থাকা এক খেয়ালী পুরুষ।

পারিবারিক চাপে চন্দ্রাবতীকে বিয়ে করলেও তার বেশিরভাগ সময় কাটতো রক্ষিতার নাচ, গান আর শরীরী সম্পর্কে। তাই সাংসারিক জীবনে মোটেই সুখী ছিলেন না চন্দ্রা। এটি খুব ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় চন্দ্রার দাদা সত্যের জন্য। তাই বোনের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সত্য একটি জীবন বীমা করায় রাজার, যেখানে তার মেডিকেল টেস্টও হয়। তবে সত্যের ভাবনা ধীরে ধীরে রুপ নেয় ষড়যন্ত্রে যখন সে ডাক্তার অশ্বিনীর কাছে জানতে পারে রাজা সিফিলিসে আক্রান্ত। অশ্বিনী রাজার দয়ায় পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন বলে প্রথমে হাত মেলাতে ভয় পান সত্যের সাথে, পরে ঘটনার চাপে পড়ে দুজনে পরিকল্পনা করেন সরিয়ে দিতে।

দার্জিলিং নিয়ে গিয়ে তাকে আর্সেনিক ঢুকিয়ে মারার চেষ্টা করেন। মৃত্যু নিশ্চিত মনে করে সেখানেই পরদিন ভোরে দাহ করা হয় রাজাকে। তবে এই দাহ করার বিষয়ে এস্টেটে ছড়িয়ে পড়ে ভিন্নবার্তা। একদিকে যেমন দাহ করার ব্যাপারটি অনেকে সমর্থন করে অন্যদিকে একটা বড় অংশ ছড়িয়ে দেয়, রাজার লাশ নিয়ে যাওয়া হলেও দাহ করা যায় নি ঝড়বৃষ্টির কারনে। পরে ঝড় থামলে গিয়ে খাটিয়াতে আর লাশ পাওয়া যায়নি। এটি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে ভাইকে খুজঁতে থাকেন বোন মৃন্ময়ী দেবী।

এক যে ছিল রাজা: জয়া আহসান
এক যে ছিল রাজা: জয়া আহসান

প্রায় ১২ বছর পর রাজার খোঁজ পাওয়া যায় সন্ন্যাসী রুপে তার এস্টেটেই। তবে ততদিনে ব্রিটিশরা দখল নিয়ে প্রজাদের নিপীড়ন করছিল। ফিরে আসা এই সন্ন্যাসীকে রাজবাড়ির সবাই বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যাচাই করে রাজা বলে ধরে নিলেও সত্য, চন্দ্রা, ডাক্তারদের বিরোধী পক্ষ তাকে লম্পট ও ভূয়া বলে মেনে নেয় না। শুরু হয় সেই কেস এবং চলতে থাকে শুনানি। কিভাবে তার পরিসমাপ্তি ঘটে তাই সিনেমাটির প্রাণ।

যারা অভিনয়ে ছিলেন এক যে ছিল রাজা সিনেমায়

যিশু সেনগুপ্ত (মেজ রাজকুমার), অঞ্জন দত্ত (উকিল ভাস্কর), অপর্ণা সেন (উকিল অনুপমা), জয়া আহসান (মৃন্ময়ী -রাজার বোন), অনির্বাণ ভট্টাচার্য(চন্দ্রার দাদা সত্য) রুদ্রনীল ঘোষ(অশ্বিনী ডাক্তার), রাজনন্দিনী পাল(রাজার স্ত্রী চন্দ্রাবতী), শ্রীনন্দা শঙ্কর (রক্ষিতা কাদম্বরী) প্রমুখ।

যে যার জায়গায় ছিলেন অনবদ্য। যীশু হয়তো তার জীবনের সবচেয়ে বড় রোলে অভিনয় করলো পুরোটা দিয়ে, সারা ছবিতে তার লুক এবং অভিনয়ে মুগ্ধ হবে দর্শক। এরপরেই জয়া আহসান, যিনি মেজদা মহেন্দ্র কুমারের সবচেয়ে কাছের বোন মৃন্ময়ী দেবীর রোলে ছিলেন মায়া, ভালবাসা আর দৃঢ়তার দারুন প্রতিফলক। রাজার স্ত্রীর সাথে ডাক্তারের লোকমুখো শোনা অবৈধ সম্পর্কের বিষয়টি সিনেমায় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলে এখানে রাজনন্দিনীর চরিত্রটি তেমন বড় হতে পারে নি। সত্যের চরিত্রে অনির্বাণ আর ডাক্তার হিসেবে রুদ্রনীল তাদের সেরাটা করেছেন। ছবিতে মূর ঘটনার পাশাপাশি ছিল উকিল দুজনের ব্যক্তিগত জীবনের একটি প্রাসঙ্গিক যোগ। তাই কেসের সাথে সাথে ভাস্কর আর অনুপমা চরিত্রে অঞ্জন দত্ত আর অপর্নার অভিনয় ছিল গুরুত্বপূর্ণ যা তারা ভালভাবে জমিয়ে রেখেছেন। রক্ষিতার চরিত্রে শ্রীনন্দা ছিলেন খুবই আকর্ষনীয়া।

এক যে ছিল রাজা: রাজার প্রত্যাবর্তন
এক যে ছিল রাজা: রাজার প্রত্যাবর্তন

পরিচালনা

সৃজিত মুখোপাধ্যায় তার অন্যান্য ছবি দিয়ে ইতিমধ্যেই সুদৃঢ় অবস্থানে আছেন। তবে এটি তার সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী গল্পের প্লট ছিল। একদিকে কেসের জেরা আর অন্যদিকে রাজার অন্তর্ধানের ঘটনা সমান্তরালভাবে চলতে থাকে ছবিতে। বিরতির আগে গল্প যথেষ্ট ধীর থাকলেও উকিলের জেরা আর ডকুমেন্টাল পরিবেশনা থাকায় বিরতির পর ছবিতে উত্তেজনা ফিরে আসে। ছবির সংলাপ আর ক্রমবিকাশ ধীর ছিল তবে শেষটায় সৃজিতের স্বভাবসুলভ ক্লাইম্যাক্স ছিল কেস হারার পর সত্যের কথা আর রাজার পরিণতিতে।

এক যে ছিল রাজার সংগীত আয়োজন

ছবির সংগীত পরিচালক আর আবহে ছিলেন ইন্দ্রদ্বীপ দাসগুপ্ত, গান লিখেছেন সৃজাতো। শ্রেয়া ঘোষাল, অরিজিত সিং, কৈলাস খেরের মত বিখ্যাতদের সাথে গান গেয়েছেন তরুন ইশান। রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছেন শাহানা বাজপেয়ী। সৃজিতের ছবি বলেই হয়তো বরাবরের মতই এ ছবির গানগুলোও ছিল দৃশ্যের সাথে পুরোপুরি মানানসই এবং শ্রুতিমধুর।

দৃশ্যায়ন

ছবির সিনেমাটোগ্রাফির কাজ করেছেন গৈরিক সরকার। বনে বাঘ শিকার,দার্জিলিং, মরুতে নাগা সন্ন্যাসীদের চলা, অন্ধকারে লাশ নেয়া কিংবা রাজার শেষ পরিণতির দৃশ্য ছিল দারুন।

সবমিলিয়ে এই ছবিতে ভাওয়াল রাজা আবার পর্দায় ফিরেছেন যতটা না লোকমুখে শোনা কথার গল্পে, তার চেয়েও বেশি কাগজ পত্র আর ব্রিটিশদের ওয়ার্ড আইনের মারপ্যাচে। তাই একে ভিন্ন পরিবেশনা বলাই যায়।

দূর্বলতা

এক যে ছিল রাজা সিনেমায় রুদ্রনীল, অনির্বাণ, রাজনন্দিনীকে ঘটনায় কম রাখায় ভাল ব্যবহার হয়নি। ছবির গতি প্রথমদিকে ধীর এবং নিদ্রাসুলভ। সেটি ডিজাইনে আভিজাত্য কম এবং মেকাপ দূর্বল লেগেছে।

রেটিংঃ ৮/১০

প্রযোজনা ও পরিবেশনায়ঃ শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস

বাজেটঃ আনুমানিক ১.৫ কোটি রুপি

বক্স অফিস কালেকশনঃ ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে সোয়া ২ কোটি রুপি।


আরও পড়ুন: 

শাহরুখ খানের জিরো সিনেমা নিয়ে একরাশ হতাশা

এক অপ্রশংসিত প্রেমের চলচ্চিত্র লায়লা মজনু’র গল্প

প্রিয় জয়া আহসান! দেবী সিনেমার পর ‘নিশীথিনী’ আপনাকেই করতে হবে

ইরাক আমেরিকা যুদ্ধের গোপন কাহিনী নিয়ে সিনেমা গ্রিন জোন(২০১০)

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top