লিটন দাস, বাংলাদেশ ক্রিকেটের আগামীর তারকা

লিটন দাস, লিটন দাসের সেঞ্চুরি, এশিয়া কাপ ২০১৮,

৫২টি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচে ৫০ গড়ে ৪২১২ রান, ৭৯ ম্যাচে ৪০ গড়ে ২৯৬৩ রান। নামটা লিটন দাস। বর্তমানের তরুণদের মধ্যে ঘরোয়াতে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা। কিন্তু ৩ বছর মিলিয়ে সেই ছেলেটাই ওয়ানডেতে পেয়েছে মাত্র ১৬ ম্যাচ। আমাদের প্রত্যাশা ছিলো লিটন দাসের উত্থান ঘটুক। তার জায়গায় সে ভালো খেলুক, বাংলাদেশে ক্রিকেটে নতুন একটা আশার নাম সংযুক্ত হোক। 

এশিয়া কাপে সুযোগ পেয়েছিলেন নিজেকে প্রমাণ করার। প্রথম ৫ ম্যাচে রান যথাক্রমে ০, ৬, ৭, ৪১ এবং ৫। কে চিন্তা করেছিল এভাবে নিন্দুকদের জবাব দিবেন? এশিয়া কাপ ফাইনালে ১২১ রানের এক অতিমানবীয় এক ইনিংস। নিন্দুকদের প্রতি এর থেকে ভালো জবাব আর কি হতে পারত? 

২০১৫ সালে অভিষেক লিটনের। বাংলাদেশ দলে ঢোকার পরপরই সবচেয়ে বেশি ট্রলের শিকার হয়েছেন লিটন দাস। কোথায় আন্তর্জাতিকে আস্তে আস্তে মানিয়ে নেবেন, সেখানে শুরুর কিছু ব্যর্থতার পর তার গায়ে লেগে গেল “ফ্ল্যাট মালিক”, ” লর্ড” এবং “কোটায় খেলে” তকমা।

তার ১৪.০৫ এভারেজ হাসাহাসিও হয়েছে প্রচুর। বোলারদের এভারেজও নাকি লিটন থেকে ভালো। ফাইনালে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির পর রেকর্ডবুকে লিখিয়েছেন নাম। সবচেয়ে কম এভারেজ নিয়ে প্রথম সেঞ্চুরি করা খেলোয়াড়দের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। রেকর্ডবুক দেখতে চান?

দেখবেন আমরা কতটা অধৈর্যের জাতি? দেখুন তাহলে রেকর্ডবুকের নামগুলো।

সূত্রঃ ইএসপিএন-ক্রিকইনফো

ধরেন, ফাইনালের ম্যাচে সেঞ্চুরি তিনি করতে পারেননি। ঠিকই তো, লিটনকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিতেন। ১২১ রানের এই ইনিংসটাকে অতিমানবীয় কেনো বলছি জানেন? ম্যাচের এই দিনে দুই দলের স্কোরকার্ড দেখেন। দুবাইয়ের ব্যাটিং বিরোধী কন্ডিশনে ভারতের স্পিন বোলিং, কোয়ালিটি পেস বোলিং মোকাবেলা করে ৪০ ওভার ব্যাটিং করা! আপনি যদি খুব বেশি প্রতিভাবান না হোন, তাহলে এই ইনিংস খেলতে পারবেন না।

বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটারদের নৈতিক অবক্ষয় | পড়তে ক্লিক করুন

হ্যাঁ তিনিও সুযোগ দিয়েছিলেন ভারতকে। ৫১ রানে তুলে দিয়েছিলেন ক্যাচ। চাহাল লুফে নিতে পারেননি। ভাগ্য যে বীরকেই সহায়তা করে। ওই একটি শট ছাড়া খেলেছেন এক ঝা চকচকে ইনিংস। চাহালকে এক ওভারে দুই ছক্কা কিংবা বুমরাহকে ডাউন দ্যা উইকেট এসে মিড অনে চার কিংবা জাদেজাকে সুইপে চার। এত সাবলীল একটা ইনিংস খেলেছেন যে, বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরা হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন, দুবাইয়ে শট খেলা কতটা কঠিন।

কিন্তু নিজের জাতের পরিচয় শুধু আজকেই দিলেন? নাকি আমরা বারবার ভুলে যাই তার কিছু ইনিংস ধারাবাহিকতা না থাকার জন্য। সাউথ আফ্রিকার মাটিতে একটি ৭৭ রানের ইনিংস আছে। সেই ইনিংসটিতে ৫-৬টি বাউন্ডারি মেরেছিলেন শুধু অফসাইডে ড্রাইভ করে।

দেশের মাটিতে ভারত এবং শ্রীলঙ্কার সাথে দেখিয়েছিলেন তিনি সুইপে কতটা স্ট্রং। অশ্বিন এবং হেরাথদের বিপক্ষে সুইপ করার সাহস কয়জনেরই বা আছে বিশ্ব ক্রিকেটে?

অসাধারণ একজন ব্যাটসম্যান হওয়ার গুণাবলি আছে এই খেলোয়াড়ের ভেতর। নার্সকে জাস্ট দাঁড়িয়ে যে ছয়টি মারলেন, সেটা আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কয়জন ব্যাটসম্যানকে মারতে দেখেছেন বা ধনঞ্জয়ার মাথার উপর দিয়ে ছয় অথবা জাস্ট রিস্টের মোচড়ে প্রদীপকে ছয়?

টেকনিক্যালি খুবই সলিড ব্যাটসম্যান। স্পিনটা খুবই ভালো খেলেন।আফগানিস্তানের সাথে ম্যাচে মুজিবকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিলেন।

প্রায়সময় শট সিলেকশন এ খুব বড় ভুল করেন, যে কারণে সুন্দরভাবে শুরু করা ইনিংসগুলোও বড় করতে পারেন না। পেস বোলিংয়ে তার দুর্বলতা অফস্টাম্পের বাইরে পড়ে ভেতরে ঢোকা বলগুলো, যেগুলো তিনি প্রায় সময়ই লেগ বিফোর অথবা ছেড়ে দিয়ে আউট হন।

লাইন লেংথ মিস করেন অনেক সময়। সবসময়ে লেগে শট খেলার প্রবণতাও আছে তার। কিন্তু তাকে সময় দিতে হবে সেটেল হওয়ার। যেকোনো পজিশনে তাকে সেটেল করে বলতে হবে, “দেখো আমি তোমাকে ২০-২৫ ম্যাচ দিচ্ছি, তুমি প্রমাণ করো নিজেকে।”

কিন্তু আমাদের বিসিবি এসব ক্ষেত্রে অনেক বেশি অধৈর্য। লিটনের প্রথম তিন ম্যাচের ব্যর্থতার পর ইমরুল-সৌম্যকে ডাকানো হল। হয়ত মাশরাফি যদি আজ তার উপর ভরসা না রাখতেন, আর কখনো দলে আসাও হত না তার।

বিসিবির এহেন কর্মকান্ডের আরেকটি উদাহরণ দেই। টেস্টে তিনি ৬-এ নেমে সফলতা পাচ্ছিলেন। কিন্তু উইন্ডিজ সফরে তাকে বলা হলো, “যাও, ওপেনিং করো।”

যদি ওপেনিং-ই করাতেন তাহলে আরো আগে থেকে সেই সুযোগ দিলেন না কেন? আচমকা একটি পেসবান্ধব কন্ডিশনে আপনি একটি স্ট্রাগলিং প্লেয়ারকে বললেন, তুমি ওপেনিং এ নামো এবং একটা ফিফটি বা হানড্রেড মেরে দাও। যদিও প্রথম পরীক্ষায় আমি বলবো, লিটন পাস করেছিল, কারণ প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংস সবার আসা যাওয়ার সে-ই দাঁড়িয়ে ছিল অনেকটা সময়।

এই ১২১ রানের ইনিংসকে হয়তো এখনো অনেকে বুঝতে পারছেন না। মনে করছেন, ঝড়ে বক মরেছে। কিন্তু এই ইনিংসটা একটা বার্তা। এশিয়া কাপের মতো টুর্নামেন্টের ফাইনালে সেঞ্চুরি!! দলের প্রয়োজনের সময় জ্বলে উঠেছেন। বড় ম্যাচে ধরে রেখেছেন টেম্পারামেন্ট। তিনি এখানে এসেছেন টেকার জন্য, এসেছেন বাংলাদেশের প্রথম “লিটন দাস” হওয়ার জন্য।

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top