অভিযাত্রীর সাহিত্য আয়োজনে আজ থাকছে সাইফুল্লাহ সাইফের একটি ছোটগল্পঃ প্রেমগুলো নদী হয়ে যায়
একটি স্রোতস্বিনী নদী অবিরত বয়ে চলছে। চারদিকে যখন নাগরিক আয়োজনের মুখে পড়ে একে একে পৃথিবীর সব প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য হারিয়ে যাবার লাইনে দাঁড়িয়েছে- সেখানে এই নদীটি কেবল একাই লড়ে যাচ্ছে শত সহস্ত্র বছরের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার গোঁড়ামিতে। তার জীবনটা মানুষ হলে তাকে আমরা জগলুল ভাইয়ের মতো করেই দেখতাম, হাসতাম। ভাবতাম, লোকটা এমন কেন? এই যুগে কেউ মোবাইল ফোন ছাড়া চলছে পারে? এ যুগে কেউ খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়? এখনো কেউ পুরনো আমলের রেডিও কানের কাছে নিয়ে বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠানমালা শুনে?
জগলুল ভাইকে নিয়ে আমরা যতই হাসি তামাশা করি না কেন, আজ পর্যন্ত উনার মতো বিদ্যা বুদ্ধিতে কাউকে দেখিনি, তাই পাগল বলে উড়িয়ে দিতে আমাদের মধ্যে একটা সংকোচ কাজ করে। আমরা তার নাম দেই আদিপুরুষ।
জগলুল ভাইকে বাদ দিয়ে আমরা নদীতে ফিরে আসি, যে নদীটা পাগলের মতো ছন্নছাড়া। এতো স্রোত এ যুগের নদীতে কীভাবে থাকে?
বছর বছর ভাঙছে, দৈর্ঘ্য- প্রস্থ বাড়িয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলীয় নেতাকর্মীর মতো নিজের শক্তির শো ডাউন করছে এ যুগের মানুষদের বিরুদ্ধে। খ্যাপাটে নদীটিকে থামানোর সব চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। দেশের নীতিকারকরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন- কি এমন ক্ষোভে একটা নদী হয়ে উঠতে পারে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা? কি এমন ব্যথা তার বুকে?
কমিটি নদীর জন্ম ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করল।
…সে অনেককাল আগের গল্প। এই গল্প কি কোন ডায়েরীতে লেখা থাকে? না লেখা আছে কোন প্রস্তরখণ্ডে? হৃদয়ের গল্প জানতে নদীর হৃৎপিণ্ড খুঁড়তে হবে। কিন্তু নদীর আবার হৃৎপিণ্ড কোথায় থাকে?
তদন্তকারীরা কিছু গৎবাঁধা বানানো যুক্তি দাঁর করালেন নিজেদের জ্ঞানের পোশাকটা আরও ভারি প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু লাভ নেই। তাদের কোন কথা ও যুক্তিকে নীতিপ্রধান মেনে নিতে পারেননি। নীতিকারকরা এবার একটা অন্য পথ ধরলেন। দেশের সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষটি খুঁজে বের করো, এই ঘোষণা দিলেন তিনি।
শুরু হল নতুন আয়োজন। পেপার-পত্রিকা, রেডিও, টিভি, মোবাইল ফোন, ফেসবুক, অনলাইন, অফলাইন সব মাধ্যমে বিশাল আয়োজনে একযোগে শুরু হল বুদ্ধি প্রতিযোগিতার রিয়্যালিটি শো। মানুষজন দলবেঁধে আসছে, লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে বুদ্ধিকে মাথা থেকে নামিয়ে নিয়ে এসে একটা যুতসই পাত্রে রেখে বিজ্ঞ বিচারকদের দেখানোর জন্য। অল্প দিনেই বেশ জনপ্রিয় এই রিয়্যালিটি শো। ফেসবুক, ইউটিউবে একেকজনের বুদ্ধির ভিডিও মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ছে। ভাইরাল হচ্ছে। লক্ষ কোটি মানুষ ভাইরাল ভিডিও নিয়ে মাতামাতি করছে, বিনোদন পাচ্ছে।
আমরাও নিয়মিত দেখি “কে হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ?” টাইটেলে রিয়্যালিটি শোটি। একসারি বিচারক যারা বুদ্ধিজীবী হিসেবে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত- নিত্য টিভি খুললেই তাদের দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে করণীয় শীর্ষক আলোচনা সভায় দেখা যায়। এমন মহামান্য বিচারক বুদ্ধিজীবীদের সামনে দেশের সেরা বুদ্ধিমান মানুষ প্রমাণ করার জন্য প্রতিযোগীদের চিন্তার অভিনব উপস্থাপন সাধারণ মানুষকে তাদের দৈনন্দিন হাজারো বিপর্যয়, ব্যর্থতা, ক্লান্তি ভুলিয়ে খাঁটি বিনোদন দিচ্ছে। মানুষ প্রাণখুলে হাসতে পারছে। ফলে লাভবান হচ্ছে দেশের পণ্য প্রচারকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
একদিন রিয়্যালিটি শো’এর লাইভ শোতে, একজন প্রতিযোগীর বুদ্ধির খেলা দেখতে দেখতে বন্ধুদের মধ্যে কেউ একজন বিরক্ত হয়ে হঠাৎ বলে ফেললো, “আমাগো জগলুল ভাই এই হালার পুতের চে অনেক বেশি জ্ঞানী মানুষ!”
আমরা একযোগে চমকে উঠি। সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে টিভি বন্ধ করে গিয়ে উঠি জগলুল ভাইয়ের কাছে।
‘ভাই! তুমিই পারবা আমাগো মুখ উজ্জল করতে। এইটা আমাগো মহল্লার সম্মানের বিষয়। তুমি জিতলে আমাগো মহল্লারে বাইরের মানুষ আর “চোরাগোকোনা” বইল্যা ডাকবো না। কেউ এলাকার নাম জিগাইলে লজ্জায় কইতে পারিনা। ‘চোরাগোকোনা’ এইটা কোনো এলাকার নাম হয়?’
জগলুল ভাই ঠোঁটের ভাঁজে হাসলেন। আমরা পাকনা পোলাপাইনের মতো আরও কঠিনভাবে ধরি তাকে। রিয়্যালিটি শোতে অংশগ্রহের জন্য জগলুল ভাইকে জোর করি, আবদার খাঁটাই। কিন্তু সে তো আদিপুরুষ! গাছের গুড়ির মতো তার শক্তি, তাকে নাড়াতে পারি না।
দেশজুড়ে বেশ অনেকদিন তোলপাড় করে রিয়্যালিটি শোয়ের নাটক শেষ হল। আমরা অভিমানে জগলুল ভাইয়ের সাথে কথা বলি না। রাস্তার মোরে দেখা হলে সালাম দেই না, তার সামনে সিগারেট টানি, তাকে দেখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পেশাব করি। জগলুল ভাই আমাদের অভিমান বোঝেন, ঘাঁটান না। বরং ঠোঁট টিপে হাসেন।
এদিকে ভয়ংকর নদীটি দেশ জাতির ভোগ ও শান্তির স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে। সবশেষে নীতিকারকরা হতাশ হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘থাক না নদীটি নদীর মতো, মানুষ মানুষের মতো!’
একদিন সন্ধ্যায় জগলুল ভাই আমাদের আড্ডায় একহাড়ি রসগোল্লা নিয়ে উপস্থিত। জগলুল ভাইকে এমন খুশিতো আর কোনদিন দেখি নাই!
জগলুল ভাই জোর করে হাড়ি থেকে একটা করে রসগোল্লা একজন একজন করে আমাদের সবার মুখের ভেতর ঢোকাতে শুরু করলেন। আমরা রস গিলতে গিলতে বলি, ঘটনা কি ভাই? কি হইছে আগে সেইটা কন?
জগলুল ভাই বললেন, নদীটি বাঁচবে। সরকার বলছে, নদী নিয়া আর ঘাঁটাঘাঁটি করবে না।
আদিপুরুষ জগলুল ভাই খুবই হাসিখুশি, যেন এখন তাকে আবদার করে এমনকি আজকের ডিজে পার্টিতেও নাচানো যাবে।
আমরা এমন নিরর্থক আবদার না করে বরং নদীর রহস্য গল্প শুনতে চাইলাম তার কাছে। তিনিও আপত্তি করলেন না। তিনি জানালেন, বহুকাল আগে নদীটির অস্তিত্ব মানুষে ছিল। দুরন্ত এক যুবক প্রেমে পড়েছিল এক অসম্ভব প্রেমিকার। তাদের প্রেম হল। এখনকার মানুষ নদীর স্রোত থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে, সেই বিদ্যুৎ তখন ছিল তাদের প্রেমে। কিন্তু যে নারী অসম্ভব, তাকে কাছে রাখা যায় না। তাদের অপূর্ণ বিদ্যুৎ প্রেমকে অনন্তকাল ধরে রাখতে প্রেম থেকে জন্ম হয় একটি স্রোতস্বিনী নদীর। মানুষ হারিয়ে যায় কিন্তু প্রেম হয়ে যায় নদী।
জগলুল ভাইয়ের কথায় আমাদের শরীর কেপে উঠে। আমরা অনুভব করি, আমাদের প্রেমগুলোও একে একে এভাবে নদী হয়েছিল। কেউ জানে না সেই প্রেমের ইতিহাস। তবুও নদী বেঁচে থাকুক।