মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল:
আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি | ত্রয়োদশ কিস্তি | চতুর্দশ কিস্তি | পঞ্চদশ কিস্তি | ষোড়শ কিস্তি | সপ্তদশ কিস্তি | ১৮’শ
যখন থামবে কোলাহল
(১৮’শ কিস্তি)
সাদাতের জ্ঞান ফিরলো সন্ধাবেলা। চরম মাত্রায় নোংরা হাসপাতালের এই ওয়ার্ডে কোন ভাল বেড নেই, সাদাত যেটাতে শুয়ে ছিল চোখ মেলার পরেই সে বুঝলো, বেশি নড়াচড়া করা ঠিক হবে না। কারন, তার পায়ের দিকের অংশের লোহাটা বোধহয় খুলেই গেছে।
এক কোণায় একটা স্যালাইন লাগানো আর ময়লা চাঁদরে শুয়ে থাকা সাদাতকে দেখলে যে কেউ খুব দুস্থই ভাববে। পায়ের দিকে কিছু পলিথিনে মোড়ানো কি যেন, একটা কম্বল, জগ আর প্লাস্টিকের থালা আর একটু দূরে গালে হাত দিয়ে ঠায় সাদাতের দিকে তাকিয়ে অনিন্দিতা বসে ছিল শুধু।
তবে চোখ মেলে সাদাত তেমন কিছু মনে করতে পারলো না কিভাবে হাসপাতালে এল, কতক্ষণ ধরে আছে। শুধু এতটুকু চোখে ভাসছিলো যে তাকে অনেক রাতের বেলা আনা হয় এখানে, সে চাঁদ দেখেছে।
সাদাতের বেডটা দরজার বাম পাশে একদম শেষে। এই রুমে চারটা বেড। তবে চার বেডেই রুগী নেই। সাদাতের ঠিক ডান পাশের বেডে একজন বেঘোরে ঘুমুচ্ছে আর নাক ডাকছে, আর বাকি দুই বেড খালি। পাশের রোগীর দিকে সাদাত একবার তাকাতেই তার চরম মাত্রায় নাক ডাকার শব্দ কানে এলো। মানুষটি তার অবচেতনে কি বিশ্বযুদ্ধ করে ফেলছে তা সে নিজেই জানেনা।
সাদাত তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যেয়েও করল না। চোখ খুলে তাকাতেই অনি বসা থেকে উঠে তার মাথার দিকে এসে দাঁড়ালো। অনি কে দেখে খুব বিধ্বস্ত মনে হল, তার চুল এলোমেলো, কাপড় কোনরকম গায়ে জড়ানো। খুব জায়গা ছিল না বলে দাঁড়ানোর সাথে সাথে অনির গা থেকে আসা ধূপ জাতীয় কিছুর গন্ধ সাদাতের নাকে এসে লাগলো। তবুও তার কাছে হার মানে নি হাসপাতালের ফিনাইলের গন্ধ। ময়লা পড়া কাঁচের ফাক দিয়ে আসা শেষবেলার রোদটুকু আটকে দাঁড়িয়ে থাকা এই অল্পচেনা অনিন্দিতাকে একদম অচেনা মনে হচ্ছিল।
‘ এই লোক কালরাত থেকেই ঘুমাচ্ছে, উঠে কিছু খায় নি। খালি নাক ডাকে আর বাকি সব্বাইরে সজাগ রাখে । আপনার কি একটু ভাল লাগতেছে?’ অনিন্দিতা মুখটা একটু নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
সাদাত বিড়বিড় করে কিছু বললো হয়তো, সেটা অনিন্দিতা বুঝতে পারল না পুরোপুরি। সাদাতের মুখের আরেকটু কাছে মুখ নিয়ে কানে কিছু একটা শোনার আশায় যখন সে, তার বুকের কাপড়ের অংশ খানিকটা সরে গিয়ে স্তনের উপরের অংশটুকুও উন্মুক্ত করে দিল। রোগীর চিন্তায় সে এতটাই অস্থির ছিল হয়তো, কাপড়ের দিকে তেমন একটা খেয়াল রাখাটাও খুব জরুরী মনে হয় নি। সাদাত সে দিকে চোখে পড়তেই চোখ সরিয়ে নিল। তবে অনি সেটা টের পেল না । ওভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
‘ক্ষুধা লেগেছে? ভাত আর বনরুটি আছে। খাবেন? ’
সাদাত মাথা নাড়লো, সে খাবে। তার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। একে বলে ‘বাঘের মত খিদে’। বনে বাঘ বেশ কিছুক্ষণ শিকার করতে না পারলে মাথা পাগলের মত করে, তখন সে সামনে যে শিকার পায় তাকে যেভাবে খায় সাদাতের তেমন ভাবে খেতে ইচ্ছে করছে। কে জানে এই স্যালাইন চলছে কতক্ষণ। মুখ ঠোট একেবারে লোনা হয়ে আছে।
অনিন্দিতা তার মাথা টেনে বালিশটা সোজা করে দিলো, সাদাত কিছুটা বসে মাথাটা বেডের সাথে রাখলো হেলান দিয়ে। তারপর সে বেডের নিচ থেকে একটা পানের পিক ফেলানোর মালশা বের করলো, তাতে বোতলে রাখা পানি দিয়ে মুখ কুলকুচি করে নিলো সাদাত। পানিটা একটু লালচে দেখালো , হয়তো আয়রন আছে। মুখে নিতেই কেমন একটা উটকো স্বাদ পেল সে।
ভাত ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। সুব্রত দুপুর পর্যন্ত হাসপাতালে থেকে রোদ একটু পড়লে বেরিয়েছেন, বের হবার আগে সে আর অনি হাসপাতালের বারান্দায় বসে খেয়েছে। ভাত একটু বেশিই আনতে বলেছিল অনি। সুব্রতেরও মনে হচ্ছিল জ্ঞান ফিরতে পারে সাদাতের। সুব্রত এখনো ফেরেননি, একা কিছুটা ভয়ও লাগছিলো অনির। সাদাতের জ্ঞান ফেরায় সে তাই একইসাথে স্বস্তি আর আনন্দ পাচ্ছে।
ভাত খাবার পর সাদাত একটা পান খেলো। সাধারনত সে পান খায়না। আজ কেন জানি তার ইচ্ছা হল। তার শরীর ভাত খাবার পর ঝরঝরে লাগছে অনেক। অনিন্দিতা ব্যাপারটাতে একটু মজাই পেয়েছে বলা যায়। সে যে পান খাওয়া দেখে মুখ লুকিয়ে একটু হাসে, সাদাত সেটা লক্ষ্য করেছে।
অনিন্দিতা মেয়েটা একটু অন্যরকমই। অন্য কেউ হলে হয়তো পুরো কাজের একটা ফিরিস্তি দিয়ে দিত এতক্ষণে। কিভাবে সাদাত কে এখানে হল, অবস্থা কেমন ছিল, ডাক্তার কি বলল, কয়দিন থাকতে হবে – এসব বলে বলে মাথা ভার করে ফেলতো। অনিন্দিতা শুধু বসেই আছে। বলার মধ্যে তার একটাই জানার আগ্রহ, ‘এখন ভালো লাগতেছে?’
মাগরিবের আযান পড়ার সাথে সাথে ঝুপ করে সন্ধা নেমে এল। একটু একটু করে আশপাশের কোলাহল থামতে লাগলো আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে আনাগোনা বেড়ে গেল মশার । অনিন্দিতা যেন কোথায় গেছে, খুব সম্ভব আশপাশে কোন মন্দিরে সান্ধ্যকালীন কোন পূতঃ করতে। সাদাত দেখে এর মাঝে জেগে উঠে বসেছে পাশের বেডের লোকটি।
কাঁচাপাকা দাড়ি আর মাথায় অল্প চুল, বয়স হয়তো চল্লিশ হবে না তবে চেহারায় অবহেলা আর স্বাস্থের বাজে অবস্থায় মনে হচ্ছে অনেক বয়স্ক । সাদাত গায়ে একটা শাল জড়িয়ে বসে আছে, একটা সিগারেট খেতে পারলে ভাল হত। আপাতত সে ভালো তে সায় দেবার উপায় নেই।
এমন সময় পাশের লোকের কাণ্ড দেখে সাদাতের চক্ষু চড়কগাছ। সে গোছা থেকে একটা বিড়ি বের করেছে এবং তোড়জোরের সাথে দিয়াশলাই খুঁজছে। সে মোটামুটি নিশ্চিত কাছেই কোথাও তার মহামূল্যবান দিয়াশলাই আছে। কয়েক মিনিট তদন্ত করে ব্যর্থ হয়ে সে অনেকটা অসহায় আত্নসমর্পণের মত সাদাতের দিকে তাকালো। পৃথিবীর সকল ধূমপায়ী এই তাকানোর ভাষা বুঝে । কিন্তু সাদাত মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘আমার কাছে ম্যাচ নেই।’
লোকটি অপ্রকৃতিস্থের মত ভাব নিয়ে আবার শুয়ে পড়লো। সাদাতের কেন জানি মায়াই লাগলো। এত ঘণ্টা ঘুমানোর পর জেগে যে লোক পৃথিবীর গতি, পেটের ক্ষুধা, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা তার হাসপাতালে তার থাকা নিয়ে আগ্রহ না দেখিয়ে বিড়ি খেতে চেয়েও পেল না, তার জন্য হয়তো এই মায়াটা চলেই আসে। সাদাত তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার সাথে কেউ নেই?’
লোকটি কিছুটা রাগ নিয়ে সাদাতের দিকে তাকালো। যেন দেয়াশলাই না দেয়ার ব্যর্থতা সে মানতে পারে নি। মোটা গলায় লোকটি বলল, ‘আপনার জাইনা কাম কি?’
‘না, মানে । আপনি তো অসুস্থ, কিছু দরকার হলে কেউ সেটা হয়তো এনে দিতে পারে।’
লোকটি সাদাতের কথায় অজানা কারনে প্রচুর রেগে যাচ্ছে, ‘নিজের কাম করেন। আমারে নিয়া ভাবতে হবে না।’
‘জ্বি , আচ্ছা।’ সাদাত মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লো। অচেনা বয়স্ক এই লোক এত বিরক্ত কেন সে বুঝতে পারছে না।
এমন সময় একটা ১৬-১৭ বছরের ছেলে একটা চাকা লাগানো ট্রে নিয়ে ঢুকলো, ট্রেতে কিছু প্যাকেট, কয়েক হালি কলা আর একটা প্লাস্টিক বোতল দেখা যাচ্ছে, খুব সম্ভব এগুলোতে পাউরুটি আর দুধ থাকে। ছেলেটা হাসপাতালের নার্সদের মত সাদা ড্রেস পড়েছে, তার শার্ট টা তার নিজের মনে হচ্ছে না, দুই সাইজ বড় হবে। আশপাশে তাকিয়ে দুইজন প্রাণী ছাড়া আর কাউকে না দেখতে পেয়ে সে বোধহয় কিছুটা হতাশই হল।
‘আফনেরা দুইজন? অহ। ’ বলেই সে পাউরুটির প্যাকেট নিয়ে দুই বেডের মাঝের টেবিলে রাখলো।
‘দুধ, চিনি, কলা আছে। কি দিয়া খাবেন?’
‘আমি কিছু খাবনা, তুমি ফেরত নিয়ে যাও।’ সাদাত বলেই তাকালো অর্ধশোয়া লোকটির দিকে। লোকটি বিকট আওয়াজ করে ছেলেটি কে ধমকে বলল, ‘ওই কুত্তার বাচ্চা, শুনোছ নাই? নিয়া যা এইসব। কেউ খাইবোনা তোদের এইসব গু গুবর।’
ছেলেটি রেগে কিছু বলতে চাইলো , এর মাঝে অনিন্দিতা এসে ঢুকলো । সে একটা পাউরুটির প্যাকেট আর দুটো কলা ছিড়ে হাতে নিয়ে বলল, ‘তুমি যাও। দুধ লাগবোনা।’
লোকটি অনিন্দিতা কে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।
‘আপনে কেডা আবার? উনার সাথে আছেন?’
অনিন্দিতা কিছু বলার আগেই সাদাত বলল, ‘সেটা আপনার জেনে কি কাজ?’
লোকটি এবার দমে গিয়ে সাদাতের দিকে একবার কড়া চোখে তাকিয়ে অনিন্দিতা কে দেখে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লো।
অনিন্দিতা পাউরুটির প্যাকেট খুলতে খুলতে বলল, ‘ আপনাকে বলা হয় নাই। একজন আসছিলো সকালে আপনাকে আনার পরেই। পাশের ওয়ার্ডের রুগীর সাথে আসছে, আপনারে চেনে মনে হয়। তবে আপনার নাম বলতে পারল না।’
এই এলাকায় সাদাত কে চেনার মত কেউ থাকার কথা না। যার চেনার কথা তার অবশ্য নাম জানারও কথা না। সাদাত অবাক হল খুব। অনিন্দিতা তার সামনে এসে দাঁড়ালো, সে আগের কাপড়টা পাল্টে এসেছে তবে একটা ধূপ গন্ধ কমে নি, বরং বেড়েছে। একসময় যে গন্ধে সাদাত নাক সিটকাতো আজ তার মন্দ লাগছে না। অনিন্দিতা বোধহয় আরো কিছু বলতে চায়।
‘যে এসেছিলো সে কি মেয়ে? কপালে টিপ পড়ার জায়গাটাতে কি তার তিল আছে?’ সাদাত অনিন্দিতাকে জিজ্ঞেস করলো।
অনিন্দিতা কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো, সাদাত জানে এই নিরবতায় কিছুটা ঈর্ষা মেশানো আছে।
(চলবে)
উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি | ত্রয়োদশ কিস্তি | চতুর্দশ কিস্তি | পঞ্চদশ কিস্তি | ষোড়শ কিস্তি | সপ্তদশ কিস্তি | ১৮’শ